
১ম সংস্করণের ভূমিকা আমার এ বইটি বিশ্বাস নিয়ে। সমাজে বিশ্বাসের প্রভাব নিয়ে। বিশ্বাসের প্রভাব সবসময়ই সমাজে ছিল, আছে। বিশ্বাস ব্যাপারটাকে এমনিতে শান্ত, সুন্দর, নিরীহ আর গোবেচারা গোছের বলে সাধারণভাবে ধরে নেয়া হলেও সময় এবং সুযোগ পেলে কীভাবে নখদন্ত বের করে তার রক্তলোলুপ চেহারাটা প্রকাশ করে দেয়, তা আমরা সবাই কমবেশি জানি। দেখেছি। বিশ্বাসের প্রভাবে বলীয়ান হয়ে মানুষ সেই প্রাচীন কাল থেকেই কুমারী এবং শিশু হত্যা করে দেবতাকে তুষ্ট করেছে, কখনো জীবন্ত কবর দিয়েছে, সতীদাহের নামে শত সহস্র নারীকে পুড়িয়ে মেরেছে, নাস্তিক, মুরতাদ কিংবা বিধর্মীদের হত্যা করেছে, চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছে, ক্রুসেড করেছে, ধর্মযুদ্ধ করেছে, ডাইনি সাব্যস্ত করে নিরপরাধ মেয়েদের পুড়িয়ে মেরেছে, কখনো বা সারা পৃথিবী জুড়ে চলছে জিহাদের নামে চলেছে রক্তের হোলি খেলা। বলতে দ্বিধা নেই, বিশ্বাস আমাদের জন্য উপকারের চেয়ে অপকারই করেছে বেশি। তারপরেও প্রশ্ন আসে, আমাদের কি বিশ্বাসের আদৌ দরকার নেই? বিজ্ঞান, সমাজ, সভ্যতা, নৈতিকতা এই সব কি বিশ্বাস ছাড়া কি একেবারেই অচল নয়? আমরা কি বিশ্বাসের উপর নির্ভর করা ছাড়াই প্রযুক্তির উন্নয়ন করতে পারব? ভবিষ্যতের গতি প্রকৃতি বুঝতে পারব? সত্য মিথ্যা, পাপ পুণ্য যাচাই করতে পারব? এই বইটিতে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবেন কৌতূহলী পাঠকেরা। আমি ২০১১ সালে আমার সহলেখক রায়হান আবীরের সাথে মিলে একটা বই লিখেছিলাম ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ নামে। বেরুনোর এক বছরের মধ্যেই বইটির সবগুলো কপি নিঃশেষিত হয়ে যায়। ২০১২ সালে বের হয় বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ। শেষ খবর যা জানি, সেই সংস্করণও নিঃশেষ। সেই বইয়ের একটি অধ্যায়ের নাম ছিল ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’। কেন আমি বিশ্বাসকে ভাইরাস মনে করি তার একটা ছোট আনুষঙ্গিক পর্যালোচনা ছিল সেখানে। বইটি বেরুনোর পর থেকেই পাঠকদের থেকে অভিমত পেয়েছিলাম – ধারণাটিকে বিস্তৃত করার। আমারও ইচ্ছে ছিল সেটা নিয়ে কাজ করার, কিন্তু হয়ে উঠেনি। এর মধ্যে গত বছর (২০১৩) ঘটা বেশ কিছু ঘটনা আমাকে এ বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস নামের একুশ বছরের এক যুবক যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গ্রেফতার হয়ে বিশ্বব্যাপী পত্র-পত্রিকার আলোচিত খবর হয়েছিলেন। নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ ও এফবিআই। সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে আমেরিকায় থাকার কারণে তার ঘটনাপ্রবাহ আমি খুব কাছ থেকে দেখি। নাফিস আমেরিকায় পড়তে এসে জিহাদ করাকে নিজের ‘কর্তব্য’ মনে করেছেন, আমেরিকাকে ‘দার আল-হারব’ হিসেবে দেখেছেন, এবং আমেরিকার মুসলিমদের বলেছেন ‘তালাফি’। তিনি কীভাবে বিন লাদেনকে প্রাণপ্রিয় নেতা মনে করেছেন, ইয়েমেনে নিহত আলকায়েদা নেতা আনোয়ার আল আওলাকির ভিডিও লেকচারগুলো তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে – এ সবকিছু আমাকে ব্যথিত এবং উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। নাফিসের মত বিশ্বাস-নির্ভর যুবকেরা যেন একেকটি টাইম-বোমা। বিশ্বাসের একেকটি বিধ্বংসী জৈবাস্ত্র যেন। তারা মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তৈরি করতে পারে নাশকতা। জলজ্যান্ত ভাইরাস যেন এরা। আমি এ নিয়ে বাংলা ব্লগে একটি লেখা লিখি ‘একজন নাফিস এবং বিশ্বাসের ভাইরাস’ শিরোনামে। কিন্তু তখনো আমার বই লেখার চিন্তাটা মাথায় আসেনি। সেই একই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সূচিত হয়েছিল অবিস্মরণীয় শাহবাগ আন্দোলন। কাদের মোল্লার সঠিক বিচারের দাবীতে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগারদের গড়ে তোলা এ আন্দোলন কাঁপিয়ে দিয়েছিল সারা বাংলাকে, এবং কিছুটা সময়ের জন্য হলেও বিশ্বকে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে সংগঠিত শাহবাগ গণআন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন। রাজীবকে শাহবাগ আন্দোলনের একেবারে শীর্ষসময়ে তার বাড়ির অদূরে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। রাজীবের হত্যার অভিযোগে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্রকে যখন গ্রেপ্তার করা হল, তারা নিজ মুখেই স্বীকার করল, ‘ঈমানী দায়িত্ব পালনের জন্য’ তারা রাজীবকে হত্যা করেছে। নর্থ সাউথের সামগ্রিক ঘটনা এবং রাজীবের উপর আক্রমণকে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ হিসেবে চিহ্নিত করে আমি একটি প্রবন্ধ লিখি অনলাইন পত্রিকায় এবং মুক্তমনা ব্লগে –‘বিশ্বাসের ভাইরাস: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় কি জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে?’ শিরোনামে। রাজীবকে হত্যার বিবরণ পড়লে হতবাক হতে হয়, কীভাবে তাদের মস্তিষ্ক ‘ব্রেন ওয়াশড’ হয়েছে প্যারাসাইটিক জিহাদি ধারণা দিয়ে। নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনার অভিযোগে নর্থ সাউথের কামেল প্রাক্তন ছাত্র কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান কিংবা রাজীব হত্যায় জড়িত নর্থ সাউথের ছাত্রদের মুখগুলোর দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ কত প্রকটভাবে মস্তিষ্ককে অধিকার করে ফেলতে পারে, যার ফলে একজনকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে খুন করতেও তাদের বাধেনি, বরং এটাকে তারা ‘ঈমানী দায়িত্ব’ বলে মনে করেছে। বিশ্বাসের ভাইরাসের প্রভাবে রাজীব হত্যার মতো ভয়ঙ্কর আলামতগুলো যখন দিনের আলোর মত উদ্ভাসিত, আশা করা হচ্ছিল যে, সরকার এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবেন। খুঁজে দেখবেন বিশ্বাসের ভাইরাসের উদ্ভব এবং সংক্রমণের মূল উৎসগুলো। কিন্তু তা না করে আওয়ামী সরকার চড়াও হল প্রগতিশীল এবং মুক্তমনা ব্লগারদের ওপর। ২০১৩ সালের পয়লা এপ্রিল বাংলা ব্লগের চারজন স্বনামখ্যাত মুক্তমনা ব্লগারকে গ্রেফতার করল ‘সেক্যুলার’ বলে কথিত আওয়ামী সরকার। বুঝলাম হেফাজতি মওলানা আর আমার দেশ এর মত প্রোপাগান্ডা মেশিনের চাপে বিশ্বাসের ভাইরাসের ব্যাপারটা আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোতেও। কিন্তু ভাইরাসের এহেন মহামারী দেখে তো আমরা চোখ বুজে থাকতে পারি না। আমার অনলাইন বন্ধুদের সাথে মিলে ব্লগারদের মুক্ত করার আন্দোলনে সামিল হলাম। শুরু হল পত্র-পত্রিকা, ফেসবুক এবং ব্লগে লেখালিখি। শুরু করলাম ‘Worldwide Protests for Free Expression in Bangladesh’ ক্যাম্পেইন। সারা পৃথিবীর মুক্তচিন্তার সংগঠনগুলো এগিয়ে এলো আমাদের ডাকে। একটা সময় পর সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হল ব্লগারদের। তখ...
Author

[Dr. Avijit Roy is a Bangladeshi-American blogger, published author, and prominent defender of the free thought movement in Bangladesh. He is an engineer by profession, but well-known for his writings in his self-founded site, Mukto-Mona—an Internet congregation of freethinkers, rationalists, skeptics, atheists, and humanists of mainly Bengali and South Asian descent. As an advocate of atheism, science, and metaphysical naturalism, he has published eight Bangla books, and many of his articles have been published in magazines and journals. His last two books, Obisshahser Dorshon (The Philosophy of Disbelief) and Biswasher Virus (The Virus of Faith), have been critically well-received and are popular Bengali books on science, skepticism, and rationalism. } লেখক হবার কোন বাসনা ছিলো তা নয়। কিন্তু ছোট্ট একটা স্বপ্ন হয়তো ছিলো একটা মনের গহীনে। স্বপ্নটা পালটে দেবার। সেই পালটে দেবার স্বপ্ন থেকেই ২০০১ সালের দিকে একদিন সমমনা কয়েকজন লেখকদের নিয়ে তৈরি করে ফেললাম মুক্তমনা সাইট (www.mukto-mona.com)। এর পর থেকেই সাইটটির বিস্তৃতি বেড়েছে। এখন বাঙালি বিজ্ঞানকর্মী, যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদীদের কাছে মুক্তমনা একটি বিশ্বস্ত নাম। ২০০৭ সালে মুক্তবুদ্ধি, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সম্যক অবদান রাখার প্রেক্ষিতে তার মুক্তমনা সাইট অর্জন করেছে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক। শখের বশে টুকিটাকি লেখা লিখছিলাম ইন্টারনেটে, ম্যাগাজিনে আর দৈনিক পত্র-পত্রিকায়। পছন্দের বিষয় প্রথম থেকেই ছিলো আধুনিক বিজ্ঞান এবং দর্শন। আমার সেসময়ের চিন্তাভাবনার গ্রন্থিত রূপ ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ (২০০৫)। এরপর একে একে অনেকগুলো বইই বের হয়েছে। তার মধ্যে, মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে (২০০৭, পুনর্মুদ্রণ ২০০৮), স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি (২০০৮), সমকামিতা: বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান (২০১০,পুনর্মুদ্রণ ২০১৩), অবিশ্বাসের দর্শন (২০১১, দ্বিতীয় প্রকাশ: ২০১২, তৃতীয় প্রকাশ: ২০১৪), বিশ্বাস ও বিজ্ঞান (২০১২), ভালবাসা কারে কয় (২০১২),এবং শূন্য থেকে মহাবিশ্ব (২০১৪: প্রকাশিতব্য)। পাঠকদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে, বইগুলো পাঠকদের ভাল লেগেছে। অনেকেই বইগুলোকে ‘ব্যতিক্রমী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, কেউবা আবার আগ বাড়িয়ে বলেছেন ‘মাইল ফলক’। তা যে ফলকই হোক না কেন, আমি এই বইগুলোর প্রতি আগ্রহ দেখে একটি ব্যাপার বুঝতে পারি যে, বাংলাদেশের শিক্ষার্থী, তরুণ-তরুণী ও সাধারণ মানুষেরা বিজ্ঞান বিমুখ নয় মোটেই, নয় দর্শনের প্রতি অনাগ্রহীও। ভাল বই তাদের আগ্রহ তৈরি করতে পারে পুরোমাত্রায়। পেশায় প্রকৌশলী। পড়াশুনা করেছি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট), পি.এইচ.ডি করেছি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরে (এন.ইউ.এস)। বর্তমানে আমেরিকায় কম্পিউটার প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত । অবসর সময় কাটে বই পড়ে, লেখালিখি করে, গান শুনে, জীবনসঙ্গিনী বন্যার নিয়মিত বকা খেয়ে, আর নিঃসীম আঁধারে আলোকিত স্বপ্ন দেখে - ‘মানুষ জাগবে তবেই কাটবে অন্ধকারের ঘোর’... ['অবিশ্বাসের দর্শন' বইয়ের ফ্ল্যাপ থেকে]